মরা গাঙ্গে বান

গর্ব (অক্টোবর ২০১১)

যুথিকা Barua
  • ২১
  • 0
( ১ )


সুবোলের মুখের দিকে তাকালেই দুঃখে বুকটা ফেটে যায় প্রমিলার। কপাল চাপড়িয়ে বিলাপ করে ওঠে,-"ভগবান! কোন কুক্ষণে যে পোলাডা জন্ম গ্রহণ করছিল, অরে ক্যান্ এত্তো বড় শ্বাস্তি তুমি দিলা!"


জন্ম থেকেই সুবোলের চোখদু'টো টঁ্যাড়া, ঠোঁট কাটা। নাকটাও পঁ্যাচার মতো বোঁচা। একেবারে নেই বললেই চলে। কথা বললে নাকে নাকে শোনায়। পরিস্কার বোঝা যায় না। দাঁতগুলি যেমন মুক্তার মতো সাদা, তেমনি কয়লার মতো কুচকুচে কালো গায়ের রং। বীভৎস চেহারা ওর। দিনের বেলাই লোকে দেখলে ভয় পায়। স্কুলের ছেলে-মেয়েরা সবাই ওকে নিয়ে রঙ্গ-তামাশা করে। ক্লাসের কেউই বসতে চায় না ওর পাশে। খেলতেও নেয় না কেউ সঙ্গে। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যে সবাই দূর দূর করে তাড়ায়। তখন বাচ্চা ছেলের মতো ভঁ্যা ভঁ্যা করে নাকে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে এসে মায়ের কাছে নালিশ করে। ব্যস, তখন পড়ে মরার উপর খাড়া। এসব সহ্য হয় কারো! একেই অভাবের সংসার। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো অবস্থা। সারাদিন মানসিক অশান্তিতে কাটে প্রমিলার। রাত পোহালেই চিন্তা, কখন চূলোয় হাঁড়ি চড়বে, রান্না বসবে। ঘরে আনাচ থাকে তো চাল-ডাল থাকেনা, তেল থাকে তো মশলাপাতি থাকে না। চিবোতে হয় শুকনো রুটি। আবার কোনো কোনোদিন তাও জোটে না। এমতবস্থায় মাথা ঠান্ডা থাকে কখনো! সুবোলকে কাঁদতে দেখলেই মাথায় রক্ত চড়ে যায় প্রমিলার। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে গর্জে ওঠে,-"হইছে কি তর? কান্দস ক্যান? মারছে বুঝি কেউ? তগোর মাষ্টারগুলা কি চোখে দ্যাখে না! হ্যাগোর আস্কারা পাইয়াই বিয়াদপ পোলাপাইনগুলা কাউরে ডরায় না। ছ্যামরাগুলা ভাবছে কি! মা-বাপ কি তর মইর্যা গ্যাছে? আমাগো গ্যারাম পঞ্চায়েতও হইছে একখান্ ডাকাইত। গরীব মাইনষের রক্ত চুইসা খাইতাছে, অথচ কামের বেলায় কিছুই করে না। নালিশ করলে উল্টা আমাগোই ধমকায়। গরীব বইল্যা আমাগো কোনো মূইল্যই নাই! মানুষডা কত্ত কষ্টে পোলারে ইসু্কলে দিছিল, অরে ল্যাখাপড়া শিক্ষাইবে, মানুষ করবে, বাপ-মায়ের দুঃখ দূর করবে! দুইমাসও হয় নাই, ছ্যামড়াগুলা অরে জ্বালাইয়া মারতাছে। পোলার হইব আর ল্যাখাপড়া? যাইব গিয়া রসাতলে। হ্যাগোর কি, হ্যারা ত্যালার মাথায় ত্যাল ঢালব, পকেট ভরাইব নিজেরার আর মরবে ঐ গরীবগুলা।"


সারাদিন বকতে বকতে চোখমুখ গর্তে ঢুকে গেছে প্রমিলার। চিন্তা-ভাবনায় শরীরটাও অর্ধেক হয়ে গেছে। কঙ্কালের মতো শরীরের হাঁড়গুলিসব বেরিয়ে এসেছে। রাতে যাও একটু ঘুম হোত, এখন সেটাও গেছে উধাও হয়ে। এদিকে সংসার একটা টলমল অবস্থা। সাধ-আহাল্লাদ তো দূর, ভালো-মন্দই জোটে না কপালে। ওদিকে ছেলের মনোরঞ্জনের জন্য গরুর বাছূর একখানা বেচে দিয়ে হরিপদ কালার টি. ভি কিনে নিয়ে এসেছে। সুবোল বাড়িতে বসেই লেখাপড়া করবে, পড়ার শেষে টি.ভি দেখবে। ওর সঙ্গী-সাথির আর প্রয়োজনই হবে না। এছাড়া আর উপায় কি! সামর্থ থাকলে নয় দূরে কোনো বোডিং-স্কুলে ভর্তি করে দিতো। এতো জ্বালা যন্ত্রণাও সহ্য করতে হোতনা। অন্তত একটু শান্তিতে দিন কাটাতে পারতো। এমন সৌভাগ্য কপালে ধরবে কোনদিন প্রমিলার! আশা করাই বৃথা। বাপ-দাদার আমলের ভিটে বাড়িসহ দুইভিগা সমান জমিটুকুই হরিপদর একমাত্র সম্বল। তার মধ্যেই আনাচপাতীর চাষ করে। উৎপন্ন ফসলের বেশীরভাগই বাজারে বিক্রি করে। কিন্তু তাতে ক'পয়সা আর উপার্জন হয়। এত বড় সংসার, কূলোয়ও না। স্ত্রী-পুত্র ছাড়াও বিধাব মা প্রভাবতী দেবী, বিকালঙ্গ ভাই নিকুঞ্জ এবং ছোটবোন রমলা এদের সবার দায়-দায়িত্ব মাথার উপর চেপে আছে হরিপদর। অথচ গায়ে-গতোরে কি বিশাল চেহারা নিকুঞ্জর। একেবারে দৈত্যের মতোন। কিন্তু ওর দুর্ভাগ্য, ছোটবেলায় পলিও রোগে ডান পা-টা প্যারালাইসের মতো হয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে ওর হাত-পাগুলি বড় দুর্বল। ভারী কোনো কাজ করতে পারেনা। বাড়িতে বসেই সংসারের টুকটাক কাজ করে। কিন্তু হরিপদর একার রোজগারে ছ'জনের অন্ন জোগাতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। পেরে ওঠে না। তবু কষ্ট হলেও কোনরকমে দিন চলে যাচ্ছিল। কোনো অশান্তি ছিল না। একমাত্র সুবোলকে নিয়েই হয়েছে যতো জ্বালা। কিন্তু ওরইবা আর দোষ কি! বয়সের তুলনায় এখনো ছেলেমানুষ। বিবেক-বুদ্ধির বিকাশই ঘটেনি। অত্যন্ত চঞ্চল। এক জায়গায় কখনো সুস্থির হয়ে বসে থাকতে পারেনা। ঘরে বাইরে প্রতিনিয়ত লাঞ্ছিত হয়, গঞ্জনা শুনতে হয়। সারাদিন ভ্রমরের মতো আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ানো ওর অভ্যাস। বাধ্যগত ছেলের মতো ঘরে বসে থাকা, বড়দের অনুসরণ করে চলা, ওসব ওর ধাতে নেই। তা'ছাড়া একনাগারে টি.ভি দেখতে কতক্ষণই বা আর ভালো লাগে। ওদিকে প্রহরীর মতো পিসি রমলা দরজার গোড়ায় কড়া নজরে পাহাড়া দিয়ে বসে থাকে। ঘর থেকে বের হলেই দেবে ওর ঠঁ্যাং ভেঙ্গে। কিন্তু কতক্ষণ, একসময় অধৈর্য্য হয়ে দরজার শিখল তুলে দিয়ে রমলা চলে যায় রান্নাঘরে। তখন ও' চিলি্ল্লয়ে ওঠে। -"দরজা খোলো, দরজা খোলো!" বলে খুব জোরে ধাক্কা দিতে থাকে দরজায়।

এ আর নতুন কি! রাত পোহালেই প্রতিদিন একই ঘটনার পূনরাবৃত্তি। সাত-সকালেই উৎপাত-উপদ্রপ, চিৎকার-চেঁচামিচি আরম্ভ হয়ে যায় সুবোলের। মাথা একেবারে চিবিয়ে খায়। রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে ওঠে রমলার। ইচ্ছা হয়, সুবোলের ঘাড়টা মটকিয়ে দিতে, ওর গলা টিপে দিতে। শেষাব্দি অতিষ্ট হয়ে, তিক্ত-বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে দিতে হয়। আর তক্ষুণি কালা বাঁদুরের মতো ঝড়ের বেগে দৌড়ে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে যায় সুবোল।

ওদিকে শোচনীয় অবস্থা প্রমিলার। মানসিক অশান্তিতে বুকের ভিতরটা পাথরের মতো ভার হয়ে আছে। শরীরের অঙ্গ-পতঙ্গগুলিও যেন ক্রমশ অসার হয়ে আসছে। সেই সকাল থেকে ভারাক্রান্ত মনে রান্নাঘরের চৌকাঠে হাঁটু ভাঁজ করে চুপ চাপ বসে আছে। মাসের শেষ, একটা কানাকড়িও নেই ঘরে। চাল, ডাল, তেল-মশলা সবই বাড়ন্ত। হরিপদ সেই কোণ্ সকালে বেরিয়েছে। শাক-সব্জি-তরিতড়কারি নিয়ে গিয়ে বসেছে বাজারে। বেচা-বিক্রি শেষ করে কখন যে বাড়ি ফিরবে, তার নির্দিষ্ট কোনো সময় সীমা নেই। এলে পরেই চূলোয় আগুন জ্বলবে, রান্না বসবে। এদিকে বেলা ক্রমশ বয়ে যাচ্ছে। এখনো পেটে কিছু পড়েনি। সবাই ক্ষুধার্ত। ক্ষিদায় চোঁ চোঁ করছে পেট। গতকালের একখানা বাশি রুটি ছিল হাঁড়িতে। সুবোল সেটা নিয়েই আমগাছের ডালে বসে বসে হনুমানের মতো চিবোচ্ছে। তা নাহলে এতক্ষণে ও' কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিতো। গুষ্ঠীর পিন্ডি চটকাতো।


বেলা বারোটা বাজে প্রায়। তখনও চূলোয় অাঁচ পড়েনি। রান্নাঘরের দরজা বন্ধ। সবাই চুপ চাপ। মুখ ভার হয়ে আছে। কেউ কথাবার্তা বলছে না। বারান্দায় বসে ব্লাউজ রিপু করছে রমলা। গোয়ালঘরের পাশে নিকুঞ্জ লাউমাচা তৈরী করছে বসে বসে। উঠোনের একপাশে শুকনো নারকেল ছুলতে বসেছে প্রমিলা। ইতিমধ্যে হাতে পানদানি নিয়ে কাশতে কাশতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন প্রভাবতী। তিনি চশমার ফাঁক দিয়ে চারিদিকে একবার নজর বুলিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে পড়লেন বারান্দায়। একটা শব্দও উচ্চারণ করলেন না। সুবোল দূর থেকে সবই লক্ষ্য করলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। কিন্তু মাথায় কিছুই ঢুকলো না। মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো আমপাতাগুলিকে পদতলে হঁ্যাচড়াতে হঁ্যাচড়াতে আপন মনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল গোয়ালঘরের দিকে। হঠাৎ ধমক দিয়ে ওঠে নিকুঞ্জ,-"হেই, শান্ত হইয়া বহস না ক্যান এক জায়গায়? খালি বাইন্দরামি, না!"
দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলে,-"ইচ্ছা করে কি, ধইরা লাগাই দুইটা!"

চমকে ওঠে সুবোল। পরিস্থিতি বেগতিক লক্ষ্য করে বাধ্য ছেলের মতো চুপচাপ নিঃশব্দে নিকুঞ্জর পাশে গিয়ে বসে পড়ে। কিন্তু গায়ে ফোসকা পড়লো প্রমিলার। হঠাৎ যেন একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল। সে একেবারে তীক্ষ্ন কণ্ঠে গর্জন করে ওঠে, -"হতচ্ছাড়া, কুলাঙ্গার, তরে নিয়া যামু কোন্ চুলোয় কয়? কে দিবে তরে ঠাঁই। সহ্যই হয় না কারো। মানইষে চেহারা সুরত দেইখ্যা হাসে, উপহাস করে। তবু রবাত ভালো আছিল, পোলা হইছিল, নইলে কাউরে মুখই দেখাইতে পাইত্তাম না। আমাগো পানিত ডুইব্যা মরতে হইত।"


পেটের ক্ষুধা সহ্য করা যায়, উপবাসে থাকা য়ায়, কিন্তু অবেলায় অসময়ে অকথা-কুকথা সহ্য হয় না প্রভাবতীর। তিনি হলেন সেকেলে মহিলা। সংস্কার বিশ্বাসী। সংস্কারপ্রবণ মন-মানসিকতা। ওনার ধারণা, এতে ঘর গৃহস্থের অকল্যাণ হয়। একেই শরীর একখানা তার রোগের ডিপু, হাই ব্ল্যাড্প্রেসার, তন্মধ্যে প্রচন্ড বাতের ব্যথা। রাতে ঘুমই হয় না ঠিকমতো। ক'দিন যাবৎ পা-দুটোতেও ফোলা ধরেছে। নড়তে চড়তে পারেন না। ঘাঁড়টাও কুঁজো হয়ে গেছে। হাঁটাচলা করতে বড্ড কষ্ট হয়। মন-মেজাজ একদম ভালো নেই। তদুপরী প্রমিলার কথাগুলো যেন তীরের মতো ছুটে এসে বিদ্ধ হলো। সম্বরণ করতে পারলেন না। ক্রোধে চোখ-মুখ রাঙিয়ে ফোঁস করে উঠলেন,-"কি অলক্ষুণে কথা শুরু করছ বৌমা! দুঃখ কি শুধু তোমার, আমাগো নাই? পোলাপাইন আমরাও তো মানুষ করছি, না কি! স্থান-কাল-জ্ঞান আছে কিছু তোমার?"

কিছুক্ষণ থেমে গলার স্বর নরম করে বললেন,-"হক্কল সময় হক্কল কথা কহন ঠিক নয় বৌমা। কি করবা, প্যাটে যখন ধরছ, অরে তো আর ফ্যালতা পারবা না। সবই ভাইগ্য। কিন্তু অভাব অনটন চিরকাল থাকব না। ভগবানে মুখ তুইল্যা একদিন চাইবই! অরে ল্যাখাপড়া শিখাও, মানুষ কর। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানাও। শত হইলেও হেতো পুরুষমানুষ। হ্যার আবার দুঃখ কিসের? শুনছি, কানা ছেলেরেও মাইনষে পদ্মলোচন কয়। কথায় আছে না,-"সোনা বঁ্যাকা হইলেও হেইডা সোনাই, এক্কারে খাঁটি সোনা।" বুঝলা বৌমা, আমাগো সুবোলও একদিন খাঁটি সোনা হইয়াই বাহির হইব, তুমি দেইখ্যা নিও! বাশি হইলেও আমার কথা একদিন লাগবই লাগব।"

ইতিমধ্যে কখন যে হরিপদ এসে আমগাছতলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মায়ের কথাগুলি আড়ি পেতে শুনছিল, কেউই টের পায় নি। হঠাৎ সবাইকে কাঁপিয়ে দিয়ে গর্জন করে ওঠে,-"মা, তুমি থামবা! ঐসব কইতেই সহজ, বুঝলা! পোলারে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানাইমু, হেই ক্ষমতা আছে আমার। না হইব কুনদিন! হ্যার ল্যাখাপড়াই তো গোল্ল্লায় গ্যাছে গিয়া। একরকম ছাইড়্যাই দিছে। এত্তো বড় বড় কথা কও কেম্নে? এসব আমাগো মুখে শোভা পায় না। ল্যাখাপড়া আমার বাবায় আমায় শিখাইছে কুনদিন? ইস্কুলে দিছিল কুনদিন? চাষার পোলারে হে চাষাই বানাইছে। লাঙ্গল একখান্ ধরাই দিছে হাতে। ইস্কুলের মুখও দেখি নাই কুনদিন। তুমি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানাইবার কথা কও। আসল কথা, সবই বরাত। বনের পশ-পক্ষীরাও দুইটা খাইয়া বাইচ্যা থাকে, আনন্দ করে। আমাগো তো জনমই বৃথা! মনুষ্যকূলে আইসা আমরা করছি কি? মানুষই হইতে পারি নাই। আমাগো সারাটা জীবন লাঙ্গল চালাইয়াই খাইতে হইব, অন্ন যুগাইতে হইব। ভুইল্যা যাইও না, আমাগো সুবোলও চাষার পোলা, হেও চাষাই হইব। অরে এত্তো বড় বড় স্বপ্ন কখনো দেখাইও না, বুঝলা? কক্ষনো না।"

চটে যান প্রভাবতী। শাড়ির অাঁচলটা কোমড়ে গুঁজতে গুঁজতে উঠোনে নেমে আসেন। ভ্রু-যুগল উত্তোলণ করে বললেন,-"দ্যাখামু না ক্যান? ক্যান দ্যাখামু না কয়? তরা রোজই অশান্তি করস! অরে পিটাশ, মারধর করস। হে হাউ হাউ কইর্যা কান্দে। এসব দেইখ্যা চুপ থাকি কেম্নে কঅ? আমরা কেহই চিরকাল বাঁইচ্যা থাকুম না! হ্যার ভবিষ্যৎ কি হইব, একবার চিন্তা করছস কেউ!"

হরিপদ নিরুত্তর। মনে মনে ভাবল, কথায় কথা বাড়ব, তালে তাল দিব প্রমিলা। অরে ইন্ধন যোগাইব রমলা। সবাইরে উচকানি দিব নিকুঞ্জ। ব্যস, লাইগ্যা যাইব গিয়া কুরুক্ষেত্র, তুমুল ঝগড়া, তর্ক-বিতর্ক। তার চে' চুপ থাকাই মঙ্গল! চিন্তাই করুম না! সুবোলের কপালে যা লিখা আছে, তাই-ই হইব! ভাবতে ভাবতে ধপ্ করে বসে পড়ে বারান্দায়।

প্রতিদিন বাজার থেকে এসে হরিপদর বিড়ি টানার অভ্যেস। অগি্নসংযোগ করে সবে মাত্র দুটান দিয়েছে, হঠাৎ গরুরবাছূর ডেকে উঠতেই ওর নজরে পড়ে, সুবোলও লাউমাচা তৈরী করতে বসেছে। নিকুঞ্জকে সহযোগীতা করছে।

মনটা তৎক্ষণাৎ ওর বিষাদে ভরে গেল। হতাশায় ফোঁস করে লম্বা একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বলল,-"হায়রে কপাল আমার, এরেই কয় অদৃষ্ট। চাইলেই কি হয় কখনো! পোলারে ইস্কুলে দিয়াও অর ল্যাখাপড়া হইল না! আর মানুষই হইব না!"

বাঁশের খুঁটি থেকে ঝুলন্ত গামছাটা টেনে নিয়ে বলল,-"হ্যারে কুঞ্জ, আজ সুবোলরেও লইয়া আইস ক্ষ্যাতে। অরেও তো শিখান লাগব।"
বলে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে গোয়ালঘরের গা-ঘেষা সরু মেঠোপথ বেয়ে হরিপদ নেমে পড়ল ক্ষেতে। তার কিছুক্ষণ পরই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল নিকুঞ্জ। ওর পিছে পিছে কাঁধে লাঙ্গল নিয়ে সুবোল এগিয়ে গেল।


( ২ )

দেখতে দেখতে কেটে যায় কয়েকটা বছর। ততদিনে সুবোল বড় হয়ে উঠেছে। ক্ষেত-খামারির ও' কাজ বেশ রপ্ত করে নিয়েছে। শ্রমিক সংখ্যাও বেড়ে তিনজন হয়েছে। আনাচপাতীও প্রচুর পরিমানে উৎপন্ন হচ্ছে। বাজারে বিক্রিও হচ্ছে খুব। পয়সা কড়ির আমদানিও বাড়ছে। ধীরে ধীরে সংসারে দেখা দেয় আর্থিক উন্নতি, স্বচ্ছলতা, পরিপূর্ণতা। সবাই খুব খুশী। একমাত্র প্রভাবতী দেবীই পারেন নি খুশী হতে। সুবোলের হাতে লাঙ্গল দেখলেই তিনি সাংঘাতিক চটে যান। রক্তের চাপ তার তিনগুন বেড়ে যায়। কত স্বপ্ন ছিল, কত আশা ছিল, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সুবোল একদিন মানুষ হবে, মা-বাবার দুঃখ মুছে দেবে, মুখ উজ্জ্বল করবে, বংশ মর্যাদা বাড়বে। কিন্তু তা আর হলো না। হবার সম্ভাবনাও নেই। মনের দুঃখে অনবরত বকতে থাকেন,-"কি কপাল কইরা আইছিলি সংসারে, কত্তগুলা বান্দর পোলাপাইনের ডরে ইস্কুল ছাইরা দিছস, ল্যাখাপড়াও বন্ধ কইরা দিছস। মুখ পোড়া, না খাইয়া পইড়া থাকলে হ্যারা খাওয়াইব তরে। আইয়া জিজ্ঞাইবও তো না কেউ। মাও হইছে একখান, খালি চিল্লায়, কামের কাম কিচ্ছুই হয় না। কেবল আমিই হাউ হাউ কইরা মরি।"

মন্ত্রের মতো প্রতিদিন একই গাঁথা শুনতে শুনতে গা সওয়া হয়ে গেছে সবার। কেউ গায়ে মাখায় না। এক কান দিয়ে ঢোকায়, আরেক কান দিয়ে বের করে দেয়। সুবোল মুখ টিপে হাসে। দূরে গিয়ে ঠাকুমাকে ভেঙ্গায়। আর মনে মনে বলে, -"হেঃ, পাগলে কি না বলে, আর ছাগলে কি না খায়!"

মাঘ মাস। শীতের বেলা। রৌদ্রখড়দ্বীপ্ত উজ্জ্বল আকাশ। ঝুরু ঝুরু শীতল হাওয়া বইছে। অথচ সূর্য্যের তাপে মালুমই হচ্ছে না। কিন্তু ঠান্ডায় ঘরের ভিতর টেকা যাচ্ছেনা। একেই মাটির দেওয়াল, কপাটহীন জানালা। ঘরের মেঝেটাও ভিজা, সঁ্যাতসেঁতে ভাব। তন্মধ্যে বাইরের শীতল বাতাস ক্রমাণ্বয়ে প্রবেশ করতে করতে সারাঘর জমে হীম হয়ে যাবার জোগার। সুবোল দু'হাত বোগলে গুঁজে থর্ থর্ করে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে আসে বাইরে। বেরিয়েই দ্যাখে, মা-ঠাকুমা দু'জনে আমগাছতলায় বসে বসে ডালের বড়ি দিচ্ছে। দ্রুত গিয়ে বসে পড়ে সেখানে। ওর পিছে পিছে রমলা এসে যোগ দিতেই মুখখানা বিকৃতি করে নিঃশব্দে সড়ে গেল সুবোল।

নজর এড়ায় না প্রমিলার। মনে মনে হাসলো। হঠাৎ পিছন ফিরতেই দ্যাখে, আশে-পাশে সুবোল কোথাও নেই। উঠোনের ডানদিকে বিরাট শাঁনবাঁধানো পুকুর। দূপুরে এই সময় জল বেশ পরিস্কার থাকে। ভাবল, বোধহয় সাঁতার দিতে নেমেছে। কিন্তু এতো ঠান্ডায়? ভাবতে ভাবতে গলা টেনে দেখলো প্রমিলা, নাঃ, পুকুরেও তো নেই! তবে কোথায় গেল সুবোল!

দৌড়ে গিয়ে ঘরে ঢুকে দ্যাখে, বিছানায় শুয়ে, গায়ে কাঁথা কম্বল জড়িয়ে, টেলিভিশনে ক্রিকেট খেলা দেখছে সুবোল। খুব মনযোগ সহকারে দেখছে। ওর চোখেমুখেও আবেগ, উদ্বেগ। কখনো আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে একেবারে সশব্দে লাফ দিয়ে উঠছে। উঠবেই তো! এখন তো আর বাচ্চা নয়। সতেরো বছরের কিশোর। ক্রিকেট খেলা বেশ ভালোই বোঝে সুবোল। আর দেখতে দেখতে একরকম নেশায় ধরে যায় ওর। শুধু দেখবার জন্য নয়, এখন নিজেই ক্রিকেট খেলবে সুবোল। ওও ক্রিকেট প্লেয়ার হবে। ইচ্ছাটা বেশ ক'দিন ধরেই ওর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। নতুন উদ্যাম-উদ্দীপণায় নিজেকে নতুন প্রত্যয়ে গড়ে তোলার উচ্চাভিলাষে প্রচন্ড উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে। কিন্তু কথাটা মা-বাবাকে বলবে কেমন করে। সাহসেই তো কুলোচ্ছে না ওর। শুনলে মা-বাবা নিশ্চয়ই রাগারাগি করবে, চিল্লাচিলি্ল করবে। কিন্তু ক্রিকেট ও' খেলবেই।

যা অনুমান করেছিল, ঠিক তাই হলো। শোনামাত্রই প্রমিলা তীব্র কণ্ঠে গজগজ করে ওঠে,-"মুখপোড়া, আমায় কি মোটেই শান্তি দিবিনি তুই! এসব কইছে কে তরে! ক্রিরিকেট খ্যালা ক্যাম্নে খ্যালে, তুই জানস?"
পরক্ষণেই নরম হয়ে বলল,-"সক্কাল সক্কাল জ্বালাস নে বাবা! খ্যালতে লাগব না! বল ছুইট্যা মাইনষের গায়ে পড়ব, হ্যারা চিল্লাচিলি্ল করব, গালি দিব। আর তুই খ্যালবিই কার লগে? যা বাবা যা, ঘরে গিয়া টি.ভি দ্যাখ গে যা। আমারে রেহাই দে!"

সুবোল নাছোরবান্দা। মাকে বোঝাবার চেষ্টা করে। মায়ের মুখে মুখে তর্ক করে। প্রতিবাদ করে বলে,-"আমি এখন বড় হয়েছি। ক্রিকেট খ্যালা কেমন করে খ্যালে, আমি খুব জানি। কাউকে লাগবে না। আমি একাই খেলবো। আমাকে পয়সা দাও।"

শুনে হাঁ করে থাকে প্রমিলা। -"পোলায় কয় কি! ক্রিরিকেট খ্যালা তুই কি বুঝস! তর বাবায় খ্যালছে কুনদিন!"
আঙ্গুল দিয়ে ওর মাথায় একটা গুঁতো মেরে বলে,-"ক্রিরিকেট খ্যালায় তরে ভাত দিব কুনদিন?


গ্রাহ্যই করল না সুবোল। হাতটা বারিয়ে দিয়ে বিব্রোত হয়ে বলে,-"বলছি পয়সা দিতে! দাও তো দাও, শিগ্গীর দাও!"

সবিস্ময়ে প্রমিলা বলল,-"পইসা, পইসা কি গাছে ধরে? করবি কি তুই পইসা দিয়া? "

-"ব্যাড-বল কিনবো।"

সুবোলের কথা শুনে ক্রোধে ফুলে ওঠে প্রমিলা। চোখমুখ রাঙিয়ে বলে,-"খ্যালা পাইছস তুই! কত্ত কষ্টের পইসা! মানুষডা রাইত দিন খাইটতাছে! চেহারাখান্ কি হাল হইছে, দ্যাখছস? বিছানায় পড়লে দ্যাখবডা কে! কইস, দিবনে ধইরা! যত্তসব আজগুবি কথাবার্তা।" বলে এক মুহূর্তও আর দাঁড়ায় না। গজ গজ করতে করতে এগিয়ে যায় পুকুরঘাটের দিকে।

সুবোল একরোখা ছেলে। প্রচন্ড জেদী। বিরল সেন্টিমেন্টাল ওর। পয়সা ও' নেবেই! ছুটে যায় ঠাকুমার কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,-"দাও তো ঠাম্মা, পয়সা দাও! আমার খুব দরকার।"

এমনিতেই নাতি বলতেই অজ্ঞান প্রভাবতী। সুবোলের মনপছন্দ চাহিদা পূরণ করতে তিনি সর্বদা প্রস্তুত থাকেন। এতক্ষণ আড়ি পেতে সব শুনছিলেন বিছানায় শুয়ে শুয়ে। কোনো প্রশ্ন না করে তৎক্ষণাৎ শাড়ির অাঁচলের গিটটা খুলে কুড়ি টাকার দু'টো নোট বের করে সুবোলের হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন,-"ঘুম থিকা উইঠ্যাই শুরু করছস! মায়ে দিব কুনদিন তরে পইসা!"

ততক্ষণে বাজপাখীর মতো টাকাটা ছোঁ মেরে টেনে নিয়ে সুবোল চোখের নিমিষে উধাও। একেবারে উর্দ্ধঃশ্বাসে দৌড়ে গিয়ে বাজার থেকে ক্রিকেট খেলার যাবতীয় সরঞ্জাম সব কিনে নিয়ে আসে। ওর স্বপ্ন, ক্রিকেট খেলবে, ভালো খেলোয়ার হবে। ওর স্বপ্নকে স্বার্থক করবে। কিন্তু খেলতেই তো পারছে না! একা একা কখনো কি ক্রিকেট খেলা যায়? তা' হলে?

মনের দুঃখে অভিমানে ব্যাড্ আর বল হাতে নিয়ে বিষন্ন মনে চুপচাপ বসে থাকে সুবোল। ওকে দেখতে পেয়ে প্রভাবতী বললেন,-"আবার কি হইল সুবলা? বইসা আছস ক্যান? ক্যাম্নে খ্যালে জানস না? ব্যাড্টা দিয়া বলটারে এক্খান বারি দিলেই তো বল ছুইট্টা পালাইব! যা, যা, উঠ!"

সুবোলকে অনুপ্রাণিত করলেন প্রভাবতী। সুবোল তৎক্ষণাৎ মানসিক অবসাদ ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ায়। সহাস্যে ঠাকুমার কথা মতোই উঠোনের এমাথা ওমাথা বলের পিছে পিছে দৌড়ায়। মনে মনে খুব আনন্দ পায়। খুশীতে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। উৎসাহ আরো বেড়ে যায়। ওর ক্রিকেট খেলার আগ্রহ দেখে হরিপদও খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়। ছেলেকে উৎসাহিত করে, সঙ্গ দেবার চেষ্টা করে। অপ্রত্যাশিত খেলার সঙ্গী পেয়ে সুবোল খুউব খুশী। ও' ব্যাড্ ধরে থাকে, হরিপদ দূর থেকে ছুটে এসে বল ছুঁড়ে মারে। বেশ জমে ওঠে খেলা। আর খেলতে খেলতে সেটা একটা রুটিন হয়ে দাঁড়ায়। বিকেলে হলেই শুরু হয় পিতা-পুত্রের ক্রিকেট খেলা। দেখতে পেয়ে ছুটে আসে পাড়া-প্রতিবেশী। ছুটে আসে পাড়ার মলয়, আবদুল, আব্বাস করিম, পান্না, ছোকু, নিতাই, রহিম, ঝন্টু, মন্টু, আরো অনেকে। সবাই করতালি দিয়ে ওঠে। খেলা ক্রমশ জমে ওঠে। উৎসাহ আরো বেড়ে যায় সুবোলের। খুউব মন লাগিয়ে খেলে। কেউ কেউ সদিচ্ছায় ক্রিকেট খেলার জন্য এগিয়ে আসে। সুবোলও সানন্দে সবাইকে টেনে নেয় ওর দলে। তখন ক্রিকেট খেলা পুরোদমে জমে ওঠে।

তারপর ধীরে ধীরে গড়ে উঠলো ক্রিকেট খেলার পুণার্ঙ্গ একটি দল। পালা করে প্রতিটি গ্রামে ক্রিকেট খেলার আমন্ত্রণে সুবোল বেমালুম ভুলে গেল, ওর অতীতের ভাগ্যবিড়ম্বণায় পদে পদে অপদস্থ, তিরস্কার, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, অপমান এবং অপবাদের দিনগুলির কথা। ভুলে গেল, দারিদ্রপীড়িত জীবনের কঠোর দুঃখ-দৈনতার কথা। যখন ও' ক্রমে ক্রমে পরিণত হয়, একজন অভিজ্ঞসম্পন্ন সমঝদার ক্রিকেট প্লেয়ার। প্রশংসিত হয় সারা গ্রামে। গ্রাম থেকে ছড়িয়ে পড়ে শহরের বিভিন্ন জায়গায়। শুনে অত্যাশ্চর্য্যজনকভাবেই বিস্মিত হলেন, গ্রামীণ পাঠশালার হেড্ মাষ্টার দত্ত মশাই এবং সগৌরবে ন্যাশানাল্ ষ্টেডিয়ামে স্থানীয় বয়েজ-ক্লাবের বাৎসরিক ক্রিকেট ম্যাচ্ অে;ংশ গ্রহণের জন্য পুরো টিম সমেত সুবোলকে অগ্রীম আমন্ত্রণ জানালেন তিনি। এ কি কম কথা। কম সৌভাগ্যের কথা। কম গৌরবের কথা। স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি কেউ।

আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে প্রমিলা। আবেগে আপ্লুত হয়ে বলে,-"ওগো, পোলায় কয় কি শুনো!"

বারান্দায় বসে বসে বিড়ি টানছিল হরিপদ। বলল,-"পোলায় নয় গো গিন্নী, গ্যারামের মাষ্টারে ডাইক্যা কইছে অরে! হেই আমাগো পঞ্চায়েত মশাইরে ধইরা সব ব্যবস্থা করছে, জানো কিছু!"

স্বপ্নের মতো মনে হয় প্রমিলার। কিছুতেই যেন বিশ্বাস হয়না। মনে মনে ভাবে-এত্তবড় অসম্ভব, সম্ভব হইল ক্যাম্নে! এ যে ভূতের মুখে রাম নাম। পোলায় সত্যিই ক্রিকেট খ্যালতে জানে তা'হলে, শিখছে কিছু! কিন্তু শিখল ক্যাম্নে ও'?

বিস্ময়ে এতোটাই অভিভূত হয়, হঠাৎ অব্যক্ত আনন্দে অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে প্রমিলার। অনুতাপে অনুতপ্ত হয়, অনুশোচনা হয়। -আহা! পোলা আমার কত্ত কষ্ট পাইছে! কত্ত চোখের পানি ফ্যালছে! কত্ত গালি দিছি অরে! মাইরও খাইছে অনেক! দু'চোখ বন্ধ করে ভক্তিভরে ভগবানকে স্মরণ করে বলে,-"সবই তোমারই ইচ্ছা প্রভু!"

বলতে বলতে হঠাৎ একধরণের কোমল বেদনাময় গহীন অনুভূতির তীব্র জাগরণে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠতেই সুবোলকে বুকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ওঠে প্রমিলা। ওদিকে হৃদয়ের দুকূল প্লাবিত করে খুশীতে আটখানা প্রভাবতী দেবী। কি করবে, দিশা খুঁজে পায় না। উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় উচ্ছাসিত চোখে ঠোঁটদু'টো চিবিয়ে চিবিয়ে সহাস্যে বলে,-"কি বৌমা, এখন কান্দ ক্যান, এঁ্যা! কি কইছিলাম! কতায় আছে না, সবুরে মোয়া ফলে! আজ ফলছে গো ফলছে!"

ঠাকুমার গলা পেয়ে দরজার কোণায় লুকিয়ে থাকে সুবোল। নজর এড়ায় না প্রভাবতী দেবীর। দৌড়ে পিছন থেকে এসে খপ্ করে ওর জামাটা টেনে ধরে বলে,-"ওই মুখপোড়া, কোই গ্যালি তুই! আয়, তরে একটু দেখি!"
ততক্ষণে ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নেয় সুবোল। একগাল হেসে বলে,-"হুড়রে!"


কিন্তু কখনো কি কল্পনা করতে পেরেছিল কেউ, সুবোল একদিন বিশ্বকাপ ক্রিকেট ম্যাচ্ অে;ংশ গ্রহণ করবে। দেশ-বিদেশ ঘুরবে। স্বপ্নেও কি ভাবতে পেরেছিল কোনদিন, হতলাঞ্ছিত, প্রবঞ্চিত, নিগৃহীত, নিপীড়িত সুবোল বিশ্বকাপ ক্রিকেট ম্যাচে চাম্পিয়ান হবে। গোল্ড্ ম্যাডেল পাবে। খ্যাতি অর্জন করবে। নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠায় প্রতিষ্ঠিত করবে। মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করবে। বংশ মর্যাদা বাড়বে।

কিন্তু ভাগ্যের লিখন রোধ করা সাধ্য কার। স্বয়ং বিধাতারও নেই। যেন মিরাকলের মতো প্রথম প্রয়াসেই একদিন তাই-ই ঘটে গেল সুবোলের জীবনে। যেদিন গ্রামীণ হেড্ মাষ্টার দত্ত মশাই-এর রিকমেন্ডে ন্যাশানাল্ ক্রিকেট ম্যাচে অংশ নিয়ে সুবোল প্রথম দিনেই বিরোধী দলকে একশ ত্রিশ রানে পরাজিত করে অনায়াসে জিতে নেয় জীবনের প্রথম পুরস্কার এবং ভূষিত হয়, দা বেষ্ট ক্রিকেট প্লেয়ার অফ্ দা ইয়ার।
স্ব্বপ্নের মতো মনে হয়। রাতারাতিই বিখ্যাত হয়ে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পেঁৗছাবার বন্ধ দুয়ারগুলি সব অচীরেই খুলে গেল সুবোলের। চারিদিকে ওর জয় জয়কার। গ্রাম থেকে ছড়িয়ে পড়ে শহরে, শহর থেকে বহুদূর-দূরান্তে, রাজ্যের অলিতে-গলিতে, প্রতিটি ক্রিকেট ভক্তদের অন্তরে।

আর সেদিন থেকেই দেখা দেয় ওর জীবনের আমূল পরিবর্তন। বিস্ময়ে অভিভূত সুবোলের মাতা-পিতাসহ ঠাকুমা, কাকা, পিসি, গ্রামের প্রতিটি মানুষ। নতুন করে শুরু হয়, সুবোলের বিদ্যাপাঠের আয়োজন, কোচিং ক্লাস। পড়াশোনাতেও আরো মনোযোগ আরো বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে ফাইনাল পরীক্ষায় সর্বোচ্চ মার্কস পাবার ইচ্ছানুভূতির তীব্র জাগরণ এবং জীবনে উত্তীর্ণ ও বড় হবার স্বপ্ন ওর মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। যেদিন উচ্চাকাঙ্ক্ষিত বাসনাগুলিকে বাস্তবায়িত করার প্রত্যয় নিয়ে নিজের আত্মবিশ্বাস, মনের শক্তি, নিরলস সাধনায় নিমগ্ন হয়ে অনায়াসে পেঁৗছে যায়, সাফল্যের প্রবেশদ্বারে। আর তখনই মন্ত্রের মতো ঘুরে গেল, সুবোলের ভাগ্যের চাকাটা। রীতিমতো বদলে গেল ওর লাইফ ষ্টাইল, বেশ-ভূষা, জীবনধারার পদ্ধতি। মুছে গেল ওর পূঞ্জীভূত সমস্ত গ্লানি। মিটে গেল দারিদ্রের কঠোর যন্ত্রণা। প্রত্যেক বছর স্কলারশীপ্ নিয়ে আর একের পর এক খ্যাতনামা পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়ে জন্মদাতা মাতা-পিতা, ঠাকুমা, পিসি, কাকা সহ কলেজ, ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রী-প্রফেসর সকলকে আত্মগর্বে গৌরবাণি্বত করে তোলে। শুধু তা নয়, সকলের মন জয় করে কুড়িয়ে নেয় তাদের সকলের আদর-স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা এবং আশর্ীবাদ।

তারপর পিছন ফিরে সুবোলকে আর তাকাতে হয়নি। ধাপে ধাপে একের পর এক সৌভাগ্যের সিঁড়ি বেয়ে নির্বিঘ্নে পোঁছে যায় জীবনের চরম সাফল্যের স্বর্ণশিখরে।

সুবোল আজ বিশ্বজুড়ে স্বনামধন্য বিশ্বকাপ ক্রিকেট চাম্পিয়ান বিশ্বজিৎ চৌধুরী নামে অতি সুপরিচিত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পঁচিশ বছরের তরুণ যুবক। বিশ্ব বিখ্যাত যার নাম, যশ এবং পদোন্নতির স্রোতে হারিয়ে গেছে, শৈশব ও কৈশোরের অতি নগন্য নিগৃহীত, নিপীড়িত, হতভাগ্য সেই সুবোল। আজ যেন ও' নতুন জন্ম নিলো। আর তারই শুভার্থী ভক্তরা বিজয়মাল্য হাতে নিয়ে সাবেগে সানন্দে সগৌরবে ওকে অভিনন্দন জানাতে ভঁীড় জমিয়েছে শহরের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। বিশ্ব বিজয়ী ক্রিকেট চাম্পিয়ান শ্রী বিশ্বজিৎ চৌধুরী আজ ইংল্যান্ড থেকে দেশে ফিরছে, এ কি কম আনন্দের কথা! কম সৌভাগ্যের কথা! কম গৌরবের কথা!

আবেগে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে প্রমিলা। আনন্দে আত্মহারা হরিপদ। অশ্রুকণায় চোখ ছল্ছল্ করে ওঠে। সুবোলকে দেখার জন্য সবাই অস্থীর, উতলা হয়ে ওঠে। যার পর্দাপণে হরিপদর অন্ধকার ঘরে আজ জ্বলে উঠবে একরাশ উজ্জ্বল দ্বীপ্তিময় আলো। এ যেন মরা গঙ্গায় বান। ঠিক যেন শুকনো নদীর বুক জোয়ার জলে কানায় কানায় ভরে যাওয়ার মতো।

সত্যিই তাই। লোকে লোকারণ্য। বিমানবন্দরে অগণিত ভক্তদের ভঁীড়। পা ফেলার জায়গা নেই। হঠাৎ শতসহস্র লোকের ভঁীড় ঠেলে প্রভাবতী দেবী সাশ্রু নয়নে এগিয়ে আসেন। সাবেগে সগৌরবে বলে ওঠেন,-"প্যাটে সোনাই ধরছিলা বৌমা! তোমরা বুঝ নাই! আমাগো সুবোল সত্যিই একখান্ খাঁটি সোনা!"

তৎক্ষণাৎ পিছন থেকে সুবোলের বাল্যবন্ধু মলয় আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বলে ওঠে,-"সোনা নয়গো ঠাকুমা, বলো হীরে, হীরের টুকরো ছেলে। আমাদের সুবোল সত্যিই হীরের টুকরো ছেলে।"

আহাল্লাদে গদ্গদ্ প্রভাবতী দেবী। আবেগে আপ্লুত হয়ে সুবোলকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। ওর চিবুকটা তুলে ধরে বললেন, -"কই দেখি, আমার দাদাভাই-এর মুখখান একবার দেখি! এইবার শিগ্গীর একখান্ লাল টুকটুকে বৌ আইন্যা দিমু তরে!"
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
প্রজাপতি মন অনেক অনেক ভালো লাগলো, আপনার গল্পটি। সব যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম। শুভকামনা রইলো।
minarmasud শুরুটা খুবই চমৎকার। ঘটনার প্রবােহ এিগেয় িগেয়িছল িঠকই িকন্তু অধ্যায় ২েত িগেয় েকমন েযন তাড়াহুেড়া হেয়েছ বেল মেন হয়। েলখায় সাবিললতা আেছ। েপ্রক্ষাপট ভাল। েলকার হাতো ভাল। সুন্দর গেল্পর জন্য ধন্যবাদ।
ম্যারিনা নাসরিন সীমা সম্ভবত আপনার লেখা এই প্রথম পড়লাম । গল্পে আবেগ থাকলে সেটাকে পাঠকের হৃদয়ের কাছে নিয়ে যায় । আপনার গল্পে সেটা পরিপূর্ণ ভাবে রয়েছে । আমার খুব ভাল লাগলো ।গল্প বড়ছোট কোন বিষয় নয় । আমার গল্প টাও একটু বড় ।হাহাহা ! শুভকামনা রইল ।
বিন আরফান. নিঃসন্দেহে অসাধারণ. বলতে দ্বিধা নেই ৫ দিলাম. যদিও আরো বেশি প্রাপ্য ছিলেন.
আশা আমার কাছে গল্পটা অসাধারণ লেগেছে। পাঠককে আকৃষ্ট করার মতো গল্প বটে। আপনার লেখার ধরণ সত্যি প্রশংসার দাবি রাখে। পড়ার সময় মনে হচ্ছিল দুর গাঁয়ের ঐ পরিবেশের সাথে আমিও মিশে আছি। আপনার গল্পের এই কথাটা (বলতে বলতে হঠাৎ একধরণের কোমল বেদনাময় গহীন অনুভূতির তীব্র জাগরণে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠতেই সুবোলকে বুকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ওঠে প্রমিলা।) আমার আঁখিজোড়াকে আনন্দঅশ্রু বিসর্জন দিতে বাধ্য করেছে। হয়তো এই প্রথম পড়লাম আপনার গল্প। তবু খুব যত্নসহকারে পড়েছি।
sakil আবেগঘন লেখা বেশ ভালো হয়েছে . আপনি সংস্কৃতির চর্চা করে তারপর যে লিখতে পারেন সেটা অনেক বড় বেপার . শুভকামনা রইলো .
আহমেদ সাবের এটা কার গর্বের গল্প - বিশ্বজিৎ চৌধুরী (সুবোল),প্রমিলা, হরিপদ না ঠাকুর মা প্রভাবতীর? সবাই জ্বল জ্বল করছেন স্বীয় ঐশ্বর্যে। একটা সুন্দর গল্প উপহার দেবার জন্য ধন্যবাদ।
ইসমাইল বিন আবেদীন অনেক বড় একটা চত গল্প লিকলেন দিদি ! তবে ভালো লেগেছে | শুভ কামনা রইলো |
মিজানুর রহমান রানা দিদি বেশ চমৎকার গল্প লিখেছেন। আপনার গল্পগুলো আমার কাছে সব সময়ই ভালো লাগে। তবে আমাদের গল্পে আপনাকে পেতে চাই। ভোট দিয়া দিলাম।
এফ, আই , জুয়েল # আসলে কোনো কিছুকে অবহেলা ,অবজ্ঞা করতে নেই । স্রষ্টা সব কিছু ভালোর জন্যই করেন । কিন্তু এই ভালোটা খুঁজতে-বুঝতে পারি না বলে আমরা অহেতুক হতাশা ও হীনমন্যতায় ভুগী । --অনেক অনেক ধন্যবাদ ।।

২৫ এপ্রিল - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪